বিবাহের আট কাহন ।। বিবাহ কত রকমের হয় ও কি কি ।।


জীবন একটা তরনীর মতো। সময় রূপ নদীতে ভাসে চলেছে জন্ম থেকে অবিরাম। এই নদীতে ভাসতে ভাসতে একবার যে ঘাটে এসে দাঁড়াতেই হয়, যে ঘাটে এসে দাঁড়ালে নৌকোর রঙ যায় বদলে, বদলে যায় কিছুটা গঠনও, সেই ঘাটের নাম বিবাহ ।
বিবাহ শব্দটি সংস্কৃত। বি পূর্বক বহ্ ধাতুর সাথে ঘঞ প্রত্যয় যোগে শব্দটির জন্ম। বি উপসর্গটির অর্থ হল ‘বিশেষ রূপে’, ‘বহ্’ ধাতুর অর্থ - ‘বহন করা’, সুতরাং বিবাহ হল বিশেষ রূপে বহন করা।  
কিন্তু কি বিশেষ রূপে কী বহন করাকে বিবাহ বলা হয়। পণ্ডিতরা বলছেন - পুরুষ দ্বারা স্ত্রীর ভরণ-পোষণ এবং মানসম্ভ্রম রক্ষার সার্বিক ভার বহন করার অঙ্গীকার হল বিবাহ।সত্যিই কী তাই? নাকি এর গভিরে রয়েছে আরো অনেক রহস্য? আপনারা কমেণ্ডবক্সে লিখে জানান।

প্রায় ৫০ লক্ষ বছর আগে প্রথম মানব সদৃষ প্রানীর উদ্ভবপ্রায় ১ লক্ষ বছর আগেও মানুষ উলঙ্গ ছিল, আর পাঁচটা বন্য পশুর মতো হিংশ্র। খাদ্য সংগ্রহ, খাদ্য গ্রহন, যৌন মিলন, আত্মরক্ষার জন্য লড়াইয়ের কৌশল তৈরী, লড়াই, আর মৃত্যু।

৩০ হাজার বছর আগে প্রথম পোষাক ব্যবহার করতে শেখে। তখনও বাবা, ভাই, বোন ইত্যাদি সম্পর্কের প্রশ্নই ছিল না। তবুও সেই সময় পুরুষ ইচ্ছে করলেই যে কোন নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করতে পারত না। নারীই নির্বাচন করত যৌন-সঙ্গী। শ্রেষ্ট পুরুষই পেত যৌন সম্পর্কের আধিকার। যৌন আবেগ ও আকর্ষণ যেখানে অদম্য, ইপ্সিত নারী যেখানে পুরস্কার, লড়াই রক্তপাত ও মৃত্যু সেখানে অবধারিত। জন্ম নিল পুরুষে পুরুষে শত্রুতা, জন্ম নিল সম্পত্তির ধারনা।  জন্ম নিল গোষ্ঠি, গোষ্ঠি থেকে রাষ্ট্র।
মানুষের যৌন মিলনের চাহিদা সব ঋতুতেই থাকে। তাই লড়াই করে লাভ করা নারীকে যাতে পুনরায় হারাতে না হয়, বা বার বার লড়াই করতে না হয় সেজন্যই প্রয়োজন হল সামাজিক স্বীকৃতির।

আমরা জানি না পৃথিবীর প্রথম বিবাহে ঠিক কী কী রীতি পালন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে রচিত আকটি গ্রন্থ মনু সংহিতা বা মনু স্মৃতি থেকে আমরা সেই সময় সমাজে কত রকমের বিবাহ প্রচলিত ছিল তা জানতে পারি। শুধু তাই নয়, অনুমান করতেই পারি যে আরো পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে সমাজে ওই বিবাহ রীতিগুলি চলে আসছে।

তিনি বলছেন,  বিবাহ হল একটি সামাজিক চুক্তি বা বন্ধন যার মাধ্যমে দুজন মানব মানবীর মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
তৎকালীন সমাজের বিবাহ রীতিকে মোট আটটি ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলি - ব্রাহ্ম, দৈব, প্রাজাপত্য, গান্ধর্ব, আসুর, পৈশাচ, এবং রাক্ষস বিবাহ।

ব্রাহ্ম বিবাহ হল ব্রাহ্মণ্য আচারে বিবাহ। যেখানে কন্যার পিতা গৃহে যজ্ঞ চলাকালীন নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে কোন বেদজ্ঞ অর্থাৎ বিদ্যান সৎ ও চরিত্রবান ব্যক্তিকে উপহার - উপঢৌকন সহযোগে, বস্ত্রালঙ্কারে সুসজ্জিত নিজ কন্যা সম্প্রদান করেন। এখানে কন্যাকে উপযুক্ত পাত্রের হাতে সম্প্রদান করাই পিতার মূল উদ্যেশ্য।  যে যজ্ঞ চলছে সেই যজ্ঞাগ্নিকে বর কনে তিনবার প্রদক্ষিন করতে করতে বলতেন - তুমি আমি, আমি তুমি, তুমি স্বর্গ আমি পৃথিবী, তুমি ঋক আমি সাম অর্থাৎ তুমি পুরুষ আমি প্রকৃতি - এসো বিবাহ করে সন্তান উৎপাদন করি।

দৈব বিবাহ অনেকটা ব্রাহ্ম বিবাহের মতো হলেও কিছুটা আলাদাজ্যতষ্টোম বা ওই রকম কোন বৃহত যজ্ঞ চলাকালীন যজ্ঞের কোন পুরোহিত যাকে ঋত্বিক বলা হত, তাকেই যদি কন্যার পিতা নিজ গুনান্বিতা কন্যা দান করেন - সেটাই দৈব বিবাহ। ঐ রকম যজ্ঞ গুলি মায়ামুক্তির জন্য করা হত। তাই যজ্ঞ শেষে নিজের সবথেকে প্রিয় সামগ্রী দান করার রীতি থেকেই এই কন্য সম্প্রদান। অর্থাৎ কন্যার পিতা পুণ্যের লোভে নিজ কন্যাকে দান করতেন। এই বিবাহ কদাচিৎ হত।

সে যুগে ঋষিদের মধ্যে সবথেকে বেশি যে বিবাহ প্রচলিত ছিল তার নাম আর্য বিবাহ। এই বিবাহে বর কোন উপহার বা যৌতুক পেতেন না বা নিতেন না। বরং কন্যার পিতাকে প্রণামী স্বরূপ একটি গরু ও একটি ষাঁড় দান করতেন। গরুর পরিবর্তে একজোড়া মহিষও দান করে কন্যাকে স্ত্রীরূপে গ্রহন করতেন।   

প্রাজাপত্য বিবাহে পাত্র নিজ বা তাঁর অবিভাবক কন্যার পিতার কাছে তার কন্যা প্রার্থনা করেন। কন্যার পিতা সবদিক বিবেচনা করে উচিৎ মনে করলে পাত্রকে আমন্ত্রন জানান। পাত্র সেই আমন্ত্রনের মাধ্যমে কন্যার গৃহে যান এবং কন্যাকে বিবাহ করেন। এই নিয়মে অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এখনো বিবাহ করেন।

যে বিবাহে পাত্র-পাত্রীর নিজ পছন্দের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে তারই নাম গান্ধর্ব বিবাহ। দুই নারী পুরুষ তাদের স্বাধীন ইচ্ছাদ্বারা পরিচালিত হয়ে গোপনে কোন দেবতার সামনে মালাবদল বা অন্য কোন উপায়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকেন। এক কথায় বলা যায় গান্ধর্ব বিবাহই প্রেম করে বিবাহ করার প্রাচীন রূপ। এই বিবাহকে সামাজিক রূপদান বা আনুষ্ঠানাদি পালনে কোন প্রথাগত বাধা থাকে না। পাত্র-পাত্রীর ইচ্ছাই এই বিবাহের শেষ কথা। অর্জুনের সাথে চিত্রাঙদার এবং শকুন্তলার সাথে দুঃষ্মন্তের গান্ধর্ব বিবাহ হয়েছিল।

আসুর বিবাহে কন্যার পিতা পাত্রপক্ষের কাছে কন্যার মূল্য বা পণ দাবি করতেন। যিনি সব থেকে বেশি মূল্য বা পন দিতে পারতেন তাকেই কন্যা সম্প্রদান করা হত। অর্থাৎ এই বিবাহতে জমি বা গুরু বা যেকোন সম্পত্তি কেনা বেচার মতোই কন্যা ক্রয়-বিক্রয় করা হত। মাদ্রির সাথে পাণ্ডুর বিবাহ এবং দশরথের সাথে কৈকেয়ীর বিবাহ এভাবেই হয়েছিল।

যারা সেকালে ক্ষত্রিয় বা যোদ্ধা ছিলেন তারা অনেক সময়  বলপূর্বক কন্যাকে ছিনিয়ে নিয়ে বিবাহ করতেন - এই রূপ বিবাহকে বলা হয় রাক্ষস বিবাহ। যখন কোন সুন্দরী রমনীকে বিবাহ করা দুস্কর হয়ে পড়ত তখন ক্ষত্রিয়রা লোক লস্কর নিয়ে গিয়ে রমনীকে যেখানে পেতন সেখান থেকেই তুলে এনে ব্রাহ্মণ ডেকে হোম করে ববাহ করে নিতেনকন্যা পক্ষের লোকেরা বাধাদিতে এলে তাদের আহত করে, অঙ্গছেদ করে, এমনকি নিহত করে, ঘরের দরজা ভেঙে, দেওয়াল ভেঙে চিৎকারপরায়না ও ক্রন্দনরতা রমনীকে বলপূর্বক অপহরণ করে বিবাহ করার নামই রাক্ষস বিবাহ।

সে যুগের সমাজে সবথেকে নিকৃষ্ট, ঘৃণ্য ও বীভৎস বিবাহ যেটা চলত তার নাম পৈশাচ বিবাহ। পশু শব্দটি থেকে পিশাচ শব্দটির জন্ম। এই বিবাহটি পশুর মতো ঘৃণ্য বলেই এর নাম পৈশাচ। কন্যাকে মাদক দ্রব্য খাইয়ে মাতাল করে বা যৌণতায় উদ্দিপিত করে বা ঘুমন্ত অবস্থায় তার সাথে শারিরীক সম্পর্ক করে বিবাহ করাকেই পোইশাচ বিবাহ বলা হয়। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেও এই বিবাহ অত্যন্ত নিন্দিত ছিল।

সে যাই হোক গ্রন্থটি থেকে এটুকু প্রমানিত হয় যে আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে পর্যন্ত সমাজে এই আট প্রকার বিবাহ প্রচলিত ছিল। বর্তমান যুগে সারা পৃথিবীতে যতরকম বিবাহ হয় তা এই আট প্রকার বিবাহ নীতির বাইরে নয়। কোন না কোন ভাবে মিলে যায়। রীতি প্রকরণ কিছু আলাদা হতে পারে কিন্তু মূল কাঠামো সূক্ষ্মভাবে এক।

প্রিয় বন্ধু, ভিডিওটি আপনাদের কেমন লাগল তা অবশ্যই কমেণ্ড বক্সে জানাবেন। আপনার গঠন মূলক মতামতই আমাদের পথ চলার পাথেয়। ভালো লাগলে লাইক করুন, সেয়ার করুন। কারন যা ভালো লাগে তা সেয়ার করলে আরো ভালো লাগে। সাবস্ক্রাইব করেছেন তো? অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন সবাই।   



Comments

Popular posts from this blog

How to convert any number into word Indian Rupees in Excel

শত্রু দমন করবেন কিভাবে

অখণ্ড ভারত কত বড় ছিল?