পিতা মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য।
পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য।।
পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি প্রমং তপঃ
পিতরি পিতৃমা পন্নে পৃয়ন্তে সর্ব দেবতা
জননী জন্ম ভূমিশ্চ সর্গাৎ অপি গরীয়সী।
পিতা স্বর্গের সমান। ধর্মের আর এক নাম পিতা এবং পিতাই পরম তপস্যার আর এক নাম।
এছাড়া জন্মদাত্রী মাতা এবং জন্মভূমি দুইই স্বর্গের থেকেও মহান।
আমরা সন্তানেরা সেই স্বর্গের অধিবাসী। জন্ম থেকে বার তের বৎসর পর্যন্ত সেই
স্বর্গসুখ, সেই স্বর্গের অমৃত আকণ্ঠ পান করি। তাই ওই বয়সে বাবাকে মনে হয় পৃথিবীর
শ্রেষ্ট পুরুষ। মাকে মনে হয় শ্রেষ্ঠ বন্ধু।
স্বর্গে কেউ নিরবিচ্ছিন্ন সুখ ভোগ করতে পারে না। অসুরেরা সুযোগ পেলেই হানা
দেয়। স্বর্গ দখল করে বিতাড়িত করে স্বর্গবাসীদের। দেবতারা অমর। তাদের স্বর্গ ফিরে
পেলেই হল। সময়ের চিন্তা নেই তাদের। কিন্তু মানুষ মরণশীল। হাতে সময় খুব কম। স্বর্গ
যদি অসুর দ্বারা দখল হয়ে যায়, ওই অল্প সময়ের মধ্যে সেই স্বর্গ ফিরে পাবে কি না তার
কোন গ্যারেন্টি নেই। তাই প্রত্যেক
স্বর্গবাসীরর উচিৎ স্বর্গসুখ ভোগ করার পাশাপাশি স্বর্গের অতন্দ্র প্রহরীরূপে সজাগ
থাকা। মানুষের কাছে স্বর্গ হল মা এবং বাবা। স্বর্গবসী হল সেই মানুষ যে বাবা ও
মায়ের সাথে থাকে। কিন্তু আসুর কে? যে মানুষকে তার স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে।
আসুন এই ভিডিওতে আমরা সেই অসুরকে চিনে নিই। এবং তাকে কিভাবে আমাদের স্বর্গ
থেকে দূরে রাখা যায় তাও খুঁজে বের করি।
প্রথমেই বলেছি বার-তের বছর বয়স পর্যন্ত আমরা
অখণ্ড স্বর্গসুখ ভোগ করি। তার পরেই যত ঝামেলা। ধিরে ধীরে অসুরদের প্রবেশ ঘটে এই
স্বর্গে। আমরা ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকি বাবা মায়ের থেকে। তখন মনে হয় বাবা – মা-ই
আমার চরম শত্রু। তাদের মতো ভিলেন আর হয় না। এমনও হয় যে, মনে হতে থাকে এই মায়ের
পেটে জন্মেছিলাম কেন। এরকম বাবা থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো ছিল।
বয়স যখন একুশ বাইস পেরিয়ে যায় তখন মনে হতে থাকে
বাবা মা আমার জন্য কী করেছে! কিছুই করেনি। অন্যের বাবা মা অনেক কিছুই করছে। বাবা
মা কে আক্ষেপ করে বলি তুমি সেদিন ওই করলে আজ এই হত , এই করলে সেই হত। তোমার জন্যই
আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল।
বয়স যখন চল্লিশ পেরোয় এই আক্ষেপ আর থাকে না।
সংসারের ঘানি টানতে টানতে নিজেকে প্রায় নরকবাসী করে ফেলি আর বাবা মা ছিল, বা আছে,
এসব আলাদা করে ভাবার অবকাশই থাকে না।
বয়স যখন ষাট পেরিয় যায় – তখন আমার বাবা এই ছিল
আমার মা ঐ ছিল।
প্রিয় বন্ধু এসবের আসল কারণটা কী। এখানেই সেই
অসুরের প্রবেশ! শৈশবে আমরা সব পেয়েছির দেশে থাকি। কৈশোরে প্রবেশ করেই বাবা-মায়ের
অনুশাসনকে অত্যাচার বলে মনে হয়। একটু বাইরে বেরোতে শুরু করেই বাবা ম-কে তুলুনা
করতে শুরু করি। ওর বাবা মা এই করতে পারলে তুমি করতে পারবে না কেন? এই রকম একটা
ভাব। শুরু হয় বাবা মা কে অপদার্থ ভাবা। আসলে শুরু হয়ে যায় নিজের অপদার্থ হয়ে
যাওয়া।
যৌবনে এসে নিজের সেই অপদার্থতা ঢাকতে বাবা মা কে
দোষারোপ করি। তোমার জন্যই আমার আজ এই অবস্থা! নিজের স্বর্গকে লাথি মেরে অন্য কোথাও
স্বর্গ খোঁজার চেষ্টা। নতুন স্বর্গ বানাতে শুরু করি। সংসার করি। সন্তানের জন্ম
দিই। সেই সংসারে নিজের বাবা মা ব্রাত্য হয়ে যায়।
যৌবন থিতিয়ে আসে। নিজের সন্তান বড় হয়। সেই সন্তান
যখন নিজেকে দোষারোপ করে তখন চৈতন্য হয়। বলতে শুরু করি – আমার বাবা এই ছিল, আমার মা
ওই ছিল। পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায় ! প্রিয় বন্ধু এ খেলা চলছে নিরন্তর!
চেনা গেল কী অসুর আসলে কে? না না আমি, আপনি বা
আমরা কেন অসুর হব। আমরা হলাম স্বর্গবাসী
দেবতা। প্রথম থেকেই আমরা স্বর্গবাসী। মহাদেবের মতো সব কিছুতেই তথাস্তু বলে আমরাই
আমাদের বিপদ ডেকে আনি। অসুরকে স্বর্গে প্রবেশ করাই সেই অসুর হল আমাদের লোভ, আমাদের কামনা, আমাদের
ক্রোধ, আমাদের মোহ, আমাদের অহঙ্কার, আমাদের ঈর্ষা।
অন্যের বাবা মা তাকে কিছু দিয়েছে যেটা আমি পেলেও
ভালো লাগত – এটা লোভ। আমারও সেটা চাই – এটা কামনা। বাবা সেটা দিতে পারল না –
জন্মাল ক্রোধ। তুমি আমার জন্য কী করেছ – এটা দম্ভ, অহঙ্কার। বন্ধুর বাবা তাকে কিছু
দিয়েছে বলে আমি আমার বাবার কাছে এসে demand করছি – এটা ঈর্ষ বা হিংসা শুদ্ধ
বাংলায় যাকে বলে পরশ্রীকাতরতা। এরাই
আমাদের আসল অসুর যারা আমাদের বাবা-মা রূপী স্বর্গ থেকে বতাড়িত করে।
তাহলে এদের বধ করব কেমন করে? বধ করা অনেক পরের
কথা। এদের প্রবেশ করতে না দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু কিভাবে?
বাগানে একটি ফুল গাছের পরিচর্যা যেভাবে করেন ঠিক
সেভাবেই। গাছের গোড়ায় আগাছে জন্মাতে দেওয়া যাবে না। মাঝে মাঝে গাছের আগাছা জন্মালে
আগাছা উপড়ে ফেলা একটা সহজ সমাধান হতে পারে কিন্তু best solution কখনোই নয়। রোজ বাগানে যান। গাছের গোড়ার মাটি রোজ খুরপি
দিয়ে আলগা করে দিন। রোজ একটু করে জল দিন। এতে আগাছে জন্মাবেই না। জলের অভাবে গাছটি
মারাও যাবে না। এটাই Best Solution ।
মাতরং পিতরং চ এব সাক্ষাৎ প্রতক্ষ দেবতাম্ । দেবতাকে আমরা স্বচক্ষে দেখতে পাই
না। প্রতীক হিসেবে তার মূর্তি বানাই। মানস চক্ষে তাকে দর্শোন করি। তার জন্য কতো
আয়োজন! শাস্ত্র বলছেন – মানুষ কেবলমাত্র দুটি দেবতাকে জীবিত অবস্থাতেই স্বচক্ষে
দেখতে পায়। তাদের জড়িয়ে ধরতে পারে। আদর করতে পারে, ভালো বাসতে পারে। তারা আর কেউ
নয় নিজের বাবা এবং মা। আরাই জীবন্ত দেবমুর্তি ।
প্রতি মুহূর্তে সেই দেব দেবীর পূজার আয়োজন কী হতে পারে না! মত্বা গৃহী
নিষেবেত সদা সর্বপ্রযত্নতঃ।। শাস্ত্র
নির্দেশ দিচ্ছেন - মাতা ও পিতাকে প্রতক্ষ দেবতা মেনে গৃহী ব্যক্তি সব সময় বিশেষ
যত্নে তাঁদের সেবা করবে।
তুষ্টায়াং মাতরি শিবে তুষ্টে পিতরি পার্বতী।
তব প্রীতির্ভবেৎ দেবী পরব্রহ্ম প্রসীদতি।।
মাকে তুষ্ট করলে দেবাদিদেব মহাদেব তুষ্ট হন। পিতাকে তুষ্ট করলে দেবী পার্বতী
তুষ্ট হন। আর শিব ও পার্বতী তুষ্ট হলে স্বয়ং ভগবান প্রীত হন।
তাহলে বাবা মাকে তুষ্ট করার জন্য,
তাঁদের পূজা করার জন্য কী থাকবে সেই পূজার ডালিতে? শাস্ত্র তার বিবরণও
দিয়েছেন। শাস্ত্র বলছেন -
ঔদ্ধত্যং পরিহাসং চ তর্জনং পরিভাষণম্।
পিত্রোরগ্রে ন কুর্বন্তি যদিচ্ছেৎ আত্মনো হিতম্।।
মাতরং পিতরং বীক্ষ্য নত্বোত্তিষ্ঠেৎ সসম্ভ্রমঃ ।
বিনাজ্ঞয়া ন উপবিশেৎ সংস্থিতঃ পিতৃ শাসনে।।
বাবা ময়ের সামনে কখনো ঔদ্ধত্য প্রকাশ কোরো না। বাবা মা কে কোন কারনে কোন বিষয়ে
পরিহাস কোরো না। নিজের ভালো হবে ভেবে পিতা মাতার কাছে যা ইচ্ছে তাই কোরো না। বাবা
মায়ের কাছে শান্ত হয়ে থেকো কখন চঞ্চলতা ও ক্রোধ প্রকাশ করবে না। সবসময় বাবা মায়ের আদেশ
মেনে চলবে। যে সন্তান পিতামাতাকে কখনো কর্কশ কথা বলে না, মিষ্ট, সরল, পেলব, সুমধুর
বাক্য ব্যবহার করে সেই প্রকৃত সুসন্তান। পিতামাতাকে দর্শন করে সসম্মানে প্রনাম কোরো।
তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর যতক্ষন না তাঁরা বসতে বলছেন ততক্ষন বোসো না। পিতা
মাতার আহারের পর নিজে আহার করবে নিজের পেট ভরাবে।
জনন্যা বর্ধিতো দেহো জনকেন প্রযোজিতঃ
স্বজনৈঃ শিক্ষিতঃ প্রীত্যা সো অধমস্তান্ পরিত্যজেৎ ।।
এষামর্থে মহেশানি কৃত্বা কষ্টশতান্যপি।
প্রীণয়েৎ সততং শক্ত্যা ধর্মো হ্যেষ সনাতন।।
পিতা মাতার থেকেই এই শরীর উৎপন্ন হয়েছে। মাতা তোমায় বড় করেছে। পিতা তোমায় বড়
হওয়ার আয়জন করেছে। তাই শত শত কষ্ট স্বীকার করেও তাঁদের সন্তুষ্ট করা উচিৎ।
প্রিয় বন্ধু, এটা নিশ্চই জানেন যে, চল্লিশ বছর বয়সের পর মানুষকে আর বদলানো যায়
না। তারা যে যেমন তাকে তেমনি করেই মানিয়ে নিতে হয়। বয়স্ক মানুষেরা ক্রমশ তাদের কর্মক্ষমতা
হারাতে থেকে। স্মৃতি শক্তিও হারাতে থাকে। ক্রমশ শিশুর মতো হয়ে যেতে থাকে। তাদের
ক্রমশ শিশুর মতো করেই যত্ন নেওয়া উচিৎ।
সেই অর্থে মানুষ যখন বিয়ে করে তখন সে চার সন্তান নিয়েই বিবাহ করে। অবাক
হচ্ছেন। না অবাক হয়ার কিছুই নেই। এটাই সত্য। নিজের বাবা মা এবং শ্বশুর শাশুরী। তার
পর আসে নিজের জন্ম দেওয়া সন্তান। চার সন্তানের বয়স ক্রমশ কমতে থাকে আর গর্ভ জাত
সন্তানের বয়স ক্রমশ বাড়তে থাকে। চার সন্তান ক্রমশ সবকিছু ভুলতে থাকে আর গর্ভজাত
সন্তান ক্রমশ সব শিখতে থাকে। কালের নিয়মে ওই চারটি মানুষ, যারা আপনাদের পোশাক পরতে
শিখিয়ে ছিল তারাই একদিন পোশাক ঠিক করে পরতে পারবে না। আর আপনার গর্ভজাত সন্তান
ধীরে ধীরে পোশাক পরতে শিখবে। তাই আমাদের নিজের সন্তানের পাশাপাশি ওই চার বাবা
মায়ের বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিৎ। বাবা মায়ের গুরুত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে শাস্ত্র
বলছেন, দশজন উপাধ্যায়ের চেয়ে আচার্যের
গৌরব বেশী। একশত আচার্যের থেকেও বাবার গৌরব বেশী। আর মায়ের গৌরব পিতার থেকেও হাজার
গুন বেশী।
তাই সময় করে বাবা মা সময় দিন। তাদের সাথে গল্প করুন। তাদের শৈশবের কথা,
কৈশোরের কথা, যৌবনের সংগ্রামের কথা, ভালো লাগা মন্দ লাগা ইত্যাদি জানতে চান। তাদের
স্মৃতিচারণে তাদের মনটাও ভালো থাকবে, আমনার সাথে বাঁধনটাও অটুট থাকবে, আর আপনি
আপনার জীবন সংগ্রামে অনেক এনার্জীও পাবেন।
জীবনটা জ্বলন্ত ধূপের মতো ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। কখন মরণ আসে কেবা জানে। কে জানে
এ সুযোগ কাল আসবে কী না। সুতরাং কালকের কাজ আজকেই করুন আজকের কাজ এখুনি।
প্রিয় বন্ধু আপনার সুচিন্তিত গঠন মূলক মতামত জানান কমেণ্ড বক্সে। ভিডিওটিভালো লাগলে
লাইক করুন এবং প্রচুর শেয়ার করুন। চ্যানেলটি এখনো সাবস্ক্রাইব না করা থাকলে এখনি
সাবস্ক্রাইব করে বেল আইকনে ক্লিক করেদিন পরবর্তী আপডেট পাওয়ার জন্য। অনেক অনেক
অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন সবাই।
Comments
Post a Comment