হোলি কী ও কত রকমের ?

হোলি উৎসব কি (What is Holi festval)

শীতের রূক্ষতা আর পাতা ঝরার দিন কাটিয়ে প্রকৃতি যখন নতুন করে সেজে ওঠে, ডালে ডালে নতুন পাতা আর নতুন ফুলের ডালি নিয়ে মানুষকে আমন্ত্রন জানায় তাদের সাথে নতুন করে সেজে উঠতে, কৃষ্ণচুড়া আর পলাশ যখন আকাশে রাঙিয়ে তোলে  – তখন রঙ লাগে মানুষের মনেও। মনের সেই রঙ প্রকাশ পেতে চায় বাইরে। পবিত্রতা, ভালবাসা সাম্য ও মিলন উৎসব রূপে জন্ম নেয় -

দোল উৎসব প্রত্যেক বছর বসন্ত ঋতুতে বাংলা ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপন করা হয়। বসন্ত ঋতুতে শীতকে বিদায় জানিয়ে গ্রীষ্মকালকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য গৌধুলীবেলার আকাশ যেমন নানান রঙে রঙিন হয়ে ওঠে, তেমনি করেই আবিরের নানান রঙে হোলি উৎসব উদযাপন করা হয়।

কিন্তু কী এই হোলী? কিখাবেই বা জন্ম হল এই উতসবের? আসুন দেখি এই ভিডিওতে।

শান্তিনিকেতনে হোলি উৎসবের

মনে করা হয়, ১৯০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বসন্তপঞ্চমীতে অর্থাৎ সরস্বতী পুজার দিনে রবীন্দ্রনাথের বালক পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে পালিত হত ঋতু উৎসব। সেই থেকেই এই শান্তিনিকেতনে আজকের বসন্তোৎসবের সূচনা। তবে তখন এই অনুষ্ঠান পালনের নির্দিষ্ট কোনও তিথি ছিল না। বিভিন্ন বছর বিভিন্ন তারিখ ও তিথিতে এই উৎসব পালন করা হত। ১৯৩২ সাল থেকে (মতান্তরে ১৯২৫) এই উৎসব ‘বসন্ত উৎসব’ নামে পরিচিত হয়।  একদিন ক্ষিতিমোহন সেন এবং অন্য সঙ্গীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিন যাত্রা করছিলেন। সেটা ছিল দোলযাত্রার দিনে। সেই সন্ধ্যায় পূর্ণিমার চাঁদ ও কীর্তনের সুর কবিকে আবেগাপ্লুত করেছিল। সেই থেকেই নাকি শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের সূত্রপাত।

লাঠমার হোলি

রাধা ও তার অষ্টসখীগণ সকলেই সুন্দরী ও গৌরবর্ণের ছিল, তাই কৃষ্ণ মা যশোদার কাছে অভিযোগ করলেন “হে যশোমতী মাইয়া,রাধা কিউ গোরা ? মে কিউ কালা” ?

মা যশোদা তখন কৃষ্ণকে বললেন তুমি যদি গোপীদের গিয়ে রঙ মাখিয়ে দাও তাহলে সবাই রঙের আঙিনায় একইরকম হয়ে যাবে, যেখানে কালো ও গৌর রঙের আর কোনো বিভেদ থাকবেনা।

এরপর কৃষ্ণ ও তার দলবল গিয়ে রাধা ও তার সখীদের রঙ মাখিয়ে দেয়। প্রত্যুত্তরে গোপীরা কৃষ্ণ ও তার দলবলকে লাঠি নিয়ে তেড়ে এসেছিলেন। আর সেই থেকেই লাঠি দিয়ে মেরে লাঠমার হোলি খেলার শুরু হয়।

হরিয়ানা, রাজস্থানের মত রাজ্য গুলোতে হোলিতে ভাঙ খাওয়ার রীতি নীতি দেখতে পাওয়া যায়। সেই সমস্ত রাজ্য গুলোতে হোলির দিনে ভাঙ খেয়ে হোলি খেলা হয়।

পুরুষরা রঙ নিয়ে মহিলাদের মাখাতে গেলে মহিলারা লাঠি দিয়ে পুরুষদের পেটায়। লাঠি দিয়ে পুরুষদের পেটানো হরিয়ানা ও রাজস্থান রাজ্যের হোলি উদযাপনের এক ঐতিহাসিক পরম্পরা।

দোল যাত্রা

মথুরা, বৃন্দাবন সহ উত্তর ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে হোলি উৎসব উদযাপন করা হয় মূলত রাধা কৃষ্ণের দোল যাত্রাকে কেন্দ্র করেই।

কোন এক বসন্তপঞ্চমীর দিন শ্রীমতি রাধারানী ও কৃষ্ণ একসঙ্গে কুঞ্জ বিহার করছিলেন, এমন সময় আকাশ থেকে কিছু ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ে তাদের গায়ে।

ব্যাপারটা কি দাঁড়াল, বোঝার জন্যে কৃষ্ণ যোগবলে দেখলেন স্বর্গের দেবী ও দেবতারা রঙের উৎসব পালন করছেন আর সেই জন্যেই স্বর্গ থেকে কিছুটা পুষ্প তাদের উপর ঝড়ে পড়েছে।

শ্রীমতি রাধা তখন কৃষ্ণের কাছে রঙ খেলার জন্যে বায়না ধরলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন রাধাকে বুঝিয়ে বললেন আজকের দিনটা না হয় দেবযাতদের জন্যেই থাক! আমরা না হয় অন্যদিনে রঙের উৎসব পালন করব।

এরপরে ভগবান কৃষ্ণ শ্রীমতি রাধার রঙ খেলার আবদার পূরণ করলেন ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় কৃষ্ণ রাধা ও তার গোপীগনদের সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবনে একে অপরকে রঙ মাখিয়ে রঙের উৎসব পালন করেন।

তাই আজও বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা দোল পূর্ণিমার দিন রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহে প্রথম আবির অর্পন করেন। এরপর রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহ দোলায় চড়িয়ে শুরু হয় নগরসংকীর্তন। দোলের দিন কৃষ্ণ নামে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে ত্রিভূবন। এরপরই ভক্তরা একে অপরকে আবির দিয়ে দোলের শুভেচ্ছা জানান। শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরা ও রাধিকার জন্মস্থান জগদ্বিখ্যাত বৃন্দাবনে ১৬ দিন ধরে এই দোল উৎসব পালিত হয়।

এখানে প্রশ্ন হতে পারে কৃষ্ণ কেন বসন্ত পঞ্চমীতে হোলি না খলে ফাল্গুনী পুর্নীমায় রাধা ও তার গোপীদের নিয়ে হোলী খেললেন। এর পেছনে একটি পৌরানিক কাহিনী আছে।

হোলিকা থেকে হোলি।

একসময় হিরণ্যকশিপু নামের একজন রাক্ষস রাজা ছিল, তার ভাইকে ভগবান বিষ্ণু বধ করছিলেন।

হিরণ্যকশিপু তার ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্যে অমরত্ব বর পাওয়ার আশায় প্রজাপতি ব্রহ্মার কঠিন তপস্যা করে ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করেন। হিরণ্যকশিপুর তপস্যায় ব্রহ্মা খুশি হলে, ব্রহ্মার কাছে হিরণ্যকশিপু অমরত্ব বরের প্রার্থনা করলে ব্রহ্মা হিরণ্যকশিপুকে সরাসরি অমরত্ব বরদানের জন্যে মানা করে দেয়। তখন হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার কাছে অমরত্বের সমান ০৫টি বর চেয়ে বসে।

ব্রহ্মার কাছ থেকে চাওয়া হিরণ্যকশিপুর ০৫টি বর হল-

০১. কোনও মানুষ বা কোনও প্রাণী হিরণ্যকশিপুকে মারতে পারবে না।

০২. ঘরের ভেতরে বা ঘরের বাইরে হিরণ্যকশিপুর মৃত্যু হবে না। 

০৩. হিরণ্যকশিপুর মৃত্যু দিনেও হবে না, রাতেও হবে না।, 

০৪. হিরণ্যকশিপুর মৃত্যু অস্ত্র দ্বারাও হবে না, শস্ত্র্র দ্বারাও হবে না। এবং  

০৫. হিরণ্যকশিপুর মৃত্যু মাটিতেও হবে না, জলেও হবে না, শূন্যেও হবে না।

হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মা দ্বারা এই ০৫টি অমরত্বের বর লাভ করার পর তার রাজ্যের প্রজাদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে দেয়। অপরদিকে হিরণ্যকশিপুর প্রহ্লাদ নামের একটি পুত্র সন্তান ছিল।

প্রহ্লাদ কিন্ত তার বাবা হিরণ্যকশিপুর একদম উল্টো ছিল। শিশু অবস্থাথেকেই প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুর ভক্ত ছিল, বাবার নিষেধ অবজ্ঞা করেই সে বিষ্ণুর পূজা করতো।

এদিকে হিরণ্যকশিপু তার পুত্র প্রহ্লাদকে বাগে আনতে না পেরে, প্রহ্লাদকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেই। হিরণ্যকশিপুর বোনের নাম হোলিকা, তার কাছে ব্রহ্মার দ্বারা আশীর্বাদ প্রাপ্ত একটি চাদর ছিল।

যেই চাদরটি মুড়ি দিয়ে আগুনে প্রবেশ করলে তার শরীরে আগুনের আঁচ লাগতনা। হিরণ্যকশিপু হোলিকাকে বললেন প্রহ্লাদকে কোলে করে আগুনের মধ্যে প্রবেশ করতে। হিরণ্যকশিপুর নির্দেশে হোলিকা তখন প্রহ্লাদকে কোলে করে

আগুনের মধ্যে প্রবেশ করে, কিন্ত প্রহ্লাদ অগ্নিকুন্ডে গিয়ে ভগবান শ্রী বিষ্ণুকে স্মরণ করলে ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদে হোলিকার গায়ের চাদর উড়ে গিয়ে প্রহ্লাদের গায়ে জড়িয়ে যায়। অপরদিকে অগ্নিকুন্ডের আগুনে হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা পুড়ে ছায় হয়ে যায়। হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকার আগুনে পুড়ে মরার ঘটনাকে ঘিরেই হিন্দু ধর্মালম্বী মানুষেরা অশুভ শক্তির পরাজয় ও শুভ শক্তির আগমনের নিরিখে হোলি উৎসবের আগের দিন সন্ধে বেলা হোলিকা দহন করে অশুভ শক্তির প্রভাবকে পরাজিত করে হোলি উৎসব পালিত হয়।  

আবার এই তিথিতেই রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত তনু – চৈতন্য মহাপ্তভুর হন্ম হয়েছিল। তাই নদীয়া, মায়াপুর ইত্যাদি স্থানে দোল পূর্ণিমার মাহাত্যই আলাদা।

উৎসব এক নাম হরেক

উৎসব এক হলেও নানান জায়গায় এর নানান নাম। মহারাষ্ট্রে হোলিকে রং-পঞ্চমী বলে, উত্তরপ্রদেশের মথুরাতে এটি লাঠি-মার হোলি নামে পরিচিত। আবার হরিয়ানাতে দুলান্দি হোলি, পাঞ্জাবে হোলা মহল্লা, বিহারে ফাগওয়ান, গোয়া শিংগো, তামিলনাড়ুতে কামন পন্ডিগাই ও পশ্চিমবঙ্গে দোল পূর্ণিমা বা বসন্ত উৎসব।

খুশি ও রঙের ভালোবাসার উৎসব হল হোলি উৎসব। বাইরের ভিন্নতা ঘুচিয়ে আমরা সবাই যে সমান এটাকে স্মরণ করার জন্যই হোলি। তাই অনেক রঙ মাখুন। রঙ মাখান। কেবল শরীরে নয়, রঙ মাখুন হৃদয়ে। রাঙিয়ে তুলুন মন।  

Comments

Popular posts from this blog

How to convert any number into word Indian Rupees in Excel

শত্রু দমন করবেন কিভাবে

অখণ্ড ভারত কত বড় ছিল?